All news

হাতের ছোঁয়ায় তৈরি পণ্যে সৃজনশীলতা

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রাণের উৎসব

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করা মালা, ফুলদানিসহ নানা পণ্যে সাজানো হয়েছে স্টল। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থী। নিজেদের তৈরি এসব পণ্যের দিকে তাকিয়ে এই শিশুরা নিজেরাও মুগ্ধ। তাদের চোখেমুখে ভেসে ওঠে সেই মুগ্ধতার বিস্ময়।

নিজেদের সৃষ্টির তৃপ্তির ওই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা তাদের শিক্ষকদের মাঝেও। হাতের নিপুণ এসব কাজ দেখার পর মনে হতে বাধ্য—বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দিয়েই কেবল সম্ভব এমন নিখুঁত কাজ করা। তারা কোনোভাবেই সমাজের বোঝা নয়, বরং তারা সমাজের অমূল্য সম্পদ।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে তৈরি এসব মনোহর পণ্যসামগ্রীর পসরা বসেছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের খেলার মাঠে।

গতকাল শনিবার বিকেলে ‘এসো মিলি সবে প্রাণের উৎসবে’ শিরোনামের এই আয়োজন করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করা বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশন।

সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় বিকেল ৩টার আগেই ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা সেখানে উপস্থিত। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা সেখানে মেতে ওঠে আনন্দে। মাঠজুড়ে দেখা মেলে তাদের প্রাণবন্ত দুুরন্তপনা।

কেউ স্লাইডে চড়ছে তো কেউ নিজেদের মধ্যে কথা বলে আনন্দ ভাগাভাগি করছে। স্কুল মাঠের এক পাশে তৈরি করা হয় মঞ্চ। মঞ্চের পাশেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের তৈরি পণ্যে সাজানো হয় দুটি স্টল। সেখানে এই শিশুদের তৈরি গলার মালা, কানের দুল, কাঁথা, শাড়ি, পুতুল, কাগজের ফুলদানিসহ ঘর সাজানোর আরো অনেক সামগ্রী স্থান পেয়েছে। এসব সামগ্রী বিক্রি করছিল ওই শিশুরাই।

সঙ্গে ছিলেন তাদের শিক্ষকরা।

সুমাইয়া নামের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক শিশু শিক্ষার্থী ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে, ‘আমি গলার মালা বানাইছি। ম্যাডাম আমায় শিখাইছে। আমি আরো অনেক কিছু বানাইতে পারি।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান এবং বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক ইয়াশা সোবহান।

এ ছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ, কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হায়দার আলী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং গণ্যমান্য অতিথিরাও উপস্থিত ছিলেন।

বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশনায় অংশ নেয় ফাউন্ডেশনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু শিক্ষার্থীরা।

পরে অডিওভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ফাউন্ডেশনের যাত্রা, কিভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনতে নিরলস কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ইয়াশা সোবহান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘শুরুতে চারজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে নিয়ে ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করেছিলাম। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ৪৫০ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বিনামূল্যে লেখাপড়া করছে। শুধু লেখাপড়াই নয়, পাশাপাশি নিজের কাজ নিজে করা, গান, নাচ, সেলাই মেশিনের কাজ, বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, নামাজ, ধর্মীয় শিক্ষাসহ আরো অনেক কাজ শিখছে তারা। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই শিশুরা যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।’

তিনি বলেন, ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুকে নিয়মিত স্পিচ থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সব সময় কাজ করছে বসুন্ধরা টিস্যু। এটা বলার কারণ, তারা প্রতিটি টিস্যু বক্স থেকে এক টাকা করে ফাউন্ডেশনের জন্য ডোনেশন দিয়ে আমাদের পাশে আছে। আমি বসুন্ধরা টিস্যুসংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষ এই দিনে আমি কিছু মানুষের কথা বলতে চাই। প্রথমে বলতে চাই আমার মায়ের কথা। তিনি নিজে একজন সমাজসেবী ছিলেন। মায়ের কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে নিঃস্বার্থভাবে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে হয়। তাঁর উৎসাহেই বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা। এরই ধারাবাহিকতায় মানবিক এই কাজে যুক্ত হয়েছে আমার মেয়ে আফরোজা সোবহান। ছোটবেলা থেকেই সে কাজ করছে। বর্তমানে তার বন্ধুদেরও এই ফাউন্ডেশনের কাজে যুক্ত করেছে। আপনারা দোয়া করবেন যেন আমার সন্তানরা দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে পারে।’

ইয়াশা সোবহান বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আরো একজন বিশেষ মানুষের প্রতি, যিনি আমাদের সবার কাছে একজন গ্রেট লিডার, আমাদের উৎসাহদাতা। পেছনে থেকে সব সময় যিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন—তিনি বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান। চ্যালেঞ্জ উতরাতে সব সময় আমরা তাঁকে পাশে পেয়েছি। আর বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের কথা না বললেই নয়, যিনি সব সময় দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে আসছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য তাঁর ভালোবাসা ও অবদান অতুলনীয়।’

তিনি বলেন, ‘ফাউন্ডেশনের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনটি ছয়তলা ভবন, তিনটি স্কুল বাসসহ আরো অনেক সহায়তা দিয়ে আসছেন। আপনারা জেনে খুশি হবেন—সম্প্রতি চেয়ারম্যান স্যার কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা রিভারভিউতে পাঁচ বিঘা জমির ওপর এক লাখ স্কয়ার ফিটের সাততলা ভবন ও এক হাজার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর পড়ালেখার জন্য সুযোগ-সুবিধাসহ একটি স্কুল ফাউন্ডেশনকে উপহার দিয়েছেন।’

বক্তব্য শেষ হলে শিক্ষার্থীরা সবাই এসে ইয়াশা সোবহানকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তাদের ভালোবাসার কথা জানায়। এ সময় উপস্থিত অতিথি ও অভিভাবদের মধ্যে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এর আগে বক্তব্য দেন বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের অধ্যক্ষ শায়লা শারমিন, ইনচার্জ মেজর (অব.) মোহসিনুল করিম। এ সময় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানান, কিভাবে ফাউন্ডেশন তাঁদের সন্তানদের জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে।

ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থী আয়ানের মা আয়েশা বলেন, ‘আমার বাচ্চা যখন ফাউন্ডেশনে আসে তখন তার পটি ট্রেনিং, ব্যবহার কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমার আয়ান এখন পরিবর্তন হয়েছে।’

শিক্ষার্থী আব্দুর রাহিম বলে, ‘আমার বাবা-মা মারা গেছেন। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কারণে কেউ আমাকে স্কুলে ভর্তি নেয়নি। একদিন আমি বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের সন্ধান পাই, তখন আমার জীবনের পরিবর্তন হয়। বর্তমানে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছি। এটা সম্ভব হয়েছে ইয়াশা ম্যাডাম এবং শিক্ষকদের সহায়তায়। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াশা ম্যাডাম বিনাখরচে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষাসামগ্রী, চিকিৎসা, যাতায়াতব্যবস্থাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন। আমার স্বপ্ন আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হব। আমি বিশ্বাস করি, ফাউন্ডেশন আমার স্বপ্নপূরণে পাশে থাকবে।’

অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। তারা নাচ, গান ও নাটকের মাধ্যমে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা প্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কল্যাণকর্মীদের।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল আনন্দময় কেক কাটা পর্ব এবং রংপুর রাইডার্স দলের সঙ্গে একটি বিশেষ মুহূর্ত, যা শিশুদের আনন্দ আরো বাড়িয়ে তোলে। এ সময় রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান বলেন, ‘এখানে আসতে পেরে ভালো লাগছে। এসব বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ায় ইয়াশা ম্যাডামকে ধন্যবাদ জানাই।’

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/26-01-2025/kalerkantho-lt-2a.jpg

ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা ক্যাম্পাসে শিশুদের সঙ্গে খেলায় অংশ নেন সার্ভিস স্যাটারডেজের গ্রুপ লিডার রানিয়া আফরোজা সোবহান। ছবি : কালের কণ্ঠ

ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকায় শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকা

এর আগে গতকাল সকাল ১১টায় বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা আয়োজিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মোটর স্কিল উন্নয়নে পিকশনারি, অবস্ট্যাকল কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শিশুরা বল পাসিং খেলে। তাদের সহায়তা করেন ফাউন্ডেশনের শিক্ষক এবং আইএসডির সার্ভিস স্যাটারডেজের গ্রুপ লিডার ও সদস্যরা। এরপর ছবি আঁকতে বসানো হয় শিশুদের। ছবি আঁকা শেষে শিশুরা মেতে ওঠে নাচগানে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশন তাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবনযাত্রার মান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। এরই অংশ হিসেবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুর মোটর স্কিল উন্নয়নে এই পিকশনারি, অবস্ট্যাকল কোর্সসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুকে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আইএসডির সার্ভিস স্যাটারডেজ। সার্ভিস স্যাটারডেজের গ্রুপ লিডার আফরোজা সোবহান বলেন, ‘আজকে আমরা পিকশনারি, পিলো পাসিং, অবস্ট্যাকল কোর্স ও ফ্রি ডান্সিং আয়োজন করেছি। এসব আমাদের কার্যক্রমের অন্যতম অংশ। এতে সহযোগিতামূলক দক্ষতার বিকাশের পাশাপাশি শিশুদের মনোযোগী হওয়ার দক্ষতা এবং গ্রুপ কমিউনিকেশনের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।’

এসব কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখে ‘ডায়মন্ডস ইন দ্য রাফ’ সার্ভিস গ্রুপ। গ্রুপের সদস্য শেজাদ সোবহান বলেন, ‌‘আমাদের লক্ষ্য হলো, বিশেষভাবে সক্ষম (শারীরিক ও মানসিক) শিশুদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম আয়োজন করা। এখানে শিশুদের মোটর স্কিল উন্নয়নে নানা কার্যক্রম পরিকল্পনা করা হয়; যেখানে অংশগ্রহণকারী শিশুরা আইএসডির শিক্ষার্থীদের (৬-১২ গ্রেড) সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটাতে পারে।’

SOURCE : কালের কণ্ঠ