১৪ বছর আর ৮৬ ম্যাচে পঞ্চম

দিন দুয়েক ধরেই কার্তিকের আকাশে শ্রাবণের ছায়া। প্রকৃতির একতারায় বিষণ্ণতার টুংটাং। পার্থক্য বলতে, ম্যাচ চলাকালীন শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সবুজে ওই বিষাদ ঝরেনি অঝোরে। বাউন্ডারি লাইনের ওপারে গ্রাউন্ডসম্যানরা সদাসতর্ক থেকেছেন, অন্ধকার দূর করতে ফ্লাডলাইটের কৃত্রিম আলোর ফোয়ারা ছুটেছে, কিন্তু খেলা বন্ধ হয়নি কিছুতেই। কাঁদতে কাঁদতেও কাঁদেনি যে আকাশ!
এই খেয়ালি প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে মিরপুর টেস্টে এগোল বাংলাদেশের ক্রিকেটরথ। বিশেষ করে কাল ম্যাচের গন্তব্য নির্ধারণী দিনটিতে। বৃষ্টি হয় হয় আশঙ্কার মতো ম্যাচ হারি হারি আতঙ্কের স্রোত নিয়তই বয়ে গেছে স্বাগতিক ড্রেসিংরুমে। তবে ওই বৃষ্টি না হওয়ার মতো হারতেও হয়নি শেষ পর্যন্ত। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের শেষাঙ্কে বাংলাদেশের জয়-ঢাকে তাই কাঠি পড়ে। বিজয়ী বীরের হুঙ্কারে বাতাসে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়েন মুশফিকুর রহিম। আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাইজুল ইসলাম ভেসে থাকতে চান শূন্যে। গুমোট ড্রেসিংরুমে জমাট হয়ে বসে থাকা সতীর্থরা বেরিয়ে আসেন খলবলিয়ে। শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের কংক্রিটের কাঠামো থেকে আনন্দের তরঙ্গ ছড়িয়ে যায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলে।
টেস্ট জয় বলে কথা! পরম প্রার্থিত চরম কাক্সিক্ষত টেস্ট জয়!
সাদা পোশাকের ক্রিকেটের এই অভিজাত আঙিনায় বাংলাদেশের পথচলা শুরু ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। আর প্রথম জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের সেই জয়টি ছিল দেশের ৩৫তম ম্যাচে। কাল ৮৬তম ম্যাচে এসে জিতল মোটে পঞ্চমবারের মতো। ২০০৫-এর সেই হীরণ্ণয় জয়ের পর ২০০৯-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দুটি, ২০১৩-এর এপ্রিলে হারারেতে একটি এবং কাল আরেকটি- এই তো বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট রূপকথার পাঁচ অধ্যায়! টেস্ট খেলুড়ে আর কোনো দেশকে যে প্রথম পাঁচ বিজয়ের অধ্যায় রচনার জন্য এত বেশি ম্যাচ খেলতে হয়নি, তাতে আর অবাক কী!
এমনিতে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রবলতম প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। অথচ জয়ের সঙ্গে প্রথম আলিঙ্গন কিংবা শুরুর জয়-পঞ্চকের পরিসংখ্যানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর আফ্রিকান দেশটি থাকে না। হয়ে ওঠে নিউজিল্যান্ড। ম্যাচের সংখ্যা বিবেচনায় প্রথম জয়ের ক্ষেত্রে যেমন অন্য সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশটি এগিয়ে কেবল পঞ্চম টেস্ট খেলুড়ে দলের চেয়ে। বাংলাদেশ জিতেছে ৩৫তম ম্যাচে। আর নিউজিল্যান্ড টেস্ট অভিষেকের ২৬ বছর ও ৪৪ ম্যাচ পর পেয়েছে অধরা জয়ের স্বাদ। পঞ্চম জয়ের হিসেবেও আবার এই দুই দেশের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অস্ট্রেলিয়া তাদের পঞ্চম টেস্ট জিতেছে নবম ম্যাচে, ইংল্যান্ড ১৫তম, দক্ষিণ আফ্রিকা ২০তম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৫তম, ভারত ৪৯তম, পাকিস্তান ১৮তম, শ্রীলঙ্কা ৬২তম ও জিম্বাবুয়ে ৫১তম ম্যাচে গিয়ে। আর নিউজিল্যান্ডের লেগেছে ৮৫টি ম্যাচ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ফটোফিনিশে হারিয়েছে কিউইরা। কাল পঞ্চম ম্যাচ জেতার সময় ৮৬তম টেস্টটি যে খেলল দলটি!
৩৫তম ম্যাচে এসে বাংলাদেশ প্রথম বোঝে, টেস্ট জয় ব্যাপারটি আসলে কী! ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২২৬ রানের জয়ের পর আরেকটি জয় অধরা ৬০তম টেস্ট পর্যন্ত। এবার ক্যারিবিয়ান সফরে টানা দুই জয়। সেই গৌরবে অবশ্য একটুখানি মলিনতা ছড়িয়ে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষুণ্ণশক্তির দলটি। কিন্তু বাংলাদেশের তাতে বয়েই গেছে! রেকর্ড বইয়ে তো জয় বৈ অন্য কিছু লেখা নেই! ৬০ ও ৬১তম টেস্টের সেই জয়ের পর আরেকবার উল্লাসের উপলক্ষ নিয়ে আসে ৭৯তম ম্যাচ। ২০১৩-র এপ্রিলে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই টেস্ট ১৪৩ রানে জিতে সিরিজ ড্র করে ফেরে বাংলাদেশ। এরপর কালকের এই পঞ্চম জয়।
আগের চার জয়ের চেয়ে কালকের পঞ্চম জয়ের পথটি ছিল তুলনামূলক সহজ। লক্ষ্য মোটে ১০১ রান যে! তবু পথহারা পথিকের মতো ভুল গন্তব্যে যাওয়ার আশঙ্কার চোরাবালিতে ডুবে যেতে বসেছিল বাংলাদেশ। সেটি কি জয়ের রাস্তায় নিয়মিত না হাঁটার কারণেই? অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম অস্বীকার করেননি তা, ‘হ্যাঁ, এটি ঠিক যে টেস্ট কম জিতি বলে আজ আমাদের এমন সমস্যা হয়েছে। আর আমাদের সামনে সব সময় কিন্তু এমন সুযোগ আসে না। আসে অনেক দিন পর পর। আমাকে প্রশ্ন করলেও আমি বলতে পারব না যে, শেষ ইনিংসে কবে এমন জয়ের লক্ষ্যে খেলেছি। সেদিক থেকে বলব, জয়টা আসলে একটা অভ্যাসের ব্যাপার।’
রূঢ় অতীত সাক্ষী দিচ্ছে, সে অভ্যাস ১৪ বছরেও গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশের। আবার কালকের জয়ের হাওয়ামাখা ফুলেল ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, চলতি সিরিজেই গড়ে উঠতে পারে তা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা তিন টেস্ট জিতলেই তো হয়!
আগের চার জয়
৬ জানুয়ারি, ২০০৫
বাংলাদেশ : ৪৮৮ ও ২০৪/৯ (ডিক্লেয়ার্ড)
জিম্বাবুয়ে : ৩১২ ও ১৫৪
ফল : বাংলাদেশ ২২৬ রানে জয়ী।
৯ জুলাই, ২০০৯
বাংলাদেশ : ২৩৮ ও ৩৪৫
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৩০৭ ও ১৮১
ফল : বাংলাদেশ ৯৫ রানে জয়ী।
১৭ জুলাই, ২০০৯
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ২৩৭ ও ২০৯
বাংলাদেশ : ২৩২ ও ২১৭/৬
ফল : বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী।
২৫ এপ্রিল, ২০১৩
বাংলাদেশ : ৩৯১ ও ২৯১/৯ (ডিক্লেয়ার্ড)
জিম্বাবুয়ে : ২৮২ ও ২৫৭
ফল : বাংলাদেশ ১৪৩ রানে জয়ী।